নির্বাসন (ছোটোগল্প, লেখা : সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম)

 মেয়েটি গুটি গুটি পায়ে মাথায় ওড়না দিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে। হাতে  বাজারের ব্যাগ। সিগারেট ধরিয়ে এই দৃশ্য দেখা আমার দৈনন্দিন জীবনের একটি  অংশ।


প্রতিদিনকার রুটিনমত সকাল ১১ টার পরে আমি বারান্দায় এসে দাঁড়াই।স্ক্যাচার টা গ্রিলে হেলান দিয়ে রেখে গ্রিল ধরে দাড়িয়ে থাকি। একটা সিগারেট ধরাই। ধোঁয়া উড়িয়ে মেয়েটার হেঁটে যাওয়া দেখি।তিনতলার বারান্দা থেকে ওর মুখ দেখা যায় না ।কল্পনায় একটি মুখ এঁকে নেই। তারপর বারান্দায় রাখা প্লাস্টিকের চেয়ার টাতে বসি কিছুক্ষণ। আমার ক্ষুদ্র পরিসরের জীবনে এটা বড়সড় ঘটনা।


আমার দৌড় আক্ষরিক অর্থেই এই বারান্দা পর্যন্ত।দৌড় বলতেও সংকোচ হয় কারণ, আমি দৌঁড়াতে পারিনা।আমার এক পা নেই।তথাকথিত পঙ্গু  আমি।  তেমন কোনো কাজ করিনা।টুকটাক লেখালিখি করি।বই টই বেরোয়। কবি হিসেবে হালকা পাতলা  নামডাক আছে বলা যায়।ম্যাগাজিনের জন্য  লেখা নেয়ার জন্য সম্পাদক আসে । লেখালিখির সামান্য আয়ে আমি একলা মানুষ দিব্যি বেঁচে আছি।তিনতলার একটা রুম ভাড়া নিয়ে একটা পরিবারের সাথে সাবলেট থাকি।

বুয়া এসে একবেলা সব রান্না করে দিয়ে যায়।


খুব বেশি প্রয়োজন না হলে আমি আমার পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে যাই না। বলা যায়, বিল্ডিং এর একটা রুমে থেকে  সন্ন্যাস জীবন যাপন করি।  রুম থেকে বারান্না,  বারান্দা থেকে রুম, স্ক্যাচারের ঠক ঠক শব্দ, চেয়ারে বসে টেবিলের উপর কলম চালানো - আমার জীবনটা এত ছোটো হয়ে আসবে, আমি কোনো দিন ভাবতে পারিনি।


তিন দিন আগে একবার পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম জরুরী কাজে। তারপর আর আমার পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যাইনি। বদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।


চাইলেই বের হতে পারি, তিনতলা থেকে নামতে হয়তো একটু কষ্ট হবে, তবু বের হতে ইচ্ছে করেনা। নিজেকে একা করে রেখেছি। বেঁচে থাকাটা কখনো কখনো এমন  হয়ে যায়, নিজেকে চিনতে কষ্ট হয় কিংবা নিজেকে বেশি চেনা হয়ে গেলে বেঁচে থাকার মাত্রা পরিবর্তন হয়।


খুব বেশি ভদ্র ছেলে  আমি কোনো কালেই ছিলাম না। দুরন্ত জীবন যাপন, মফস্বলে বেড়ে উঠা আড্ডাবাজ বালক, খেলাধুলা,  প্রেম সব মিলিয়ে জীবনটা অন্য রকম রঙিন ছিলো।পড়াশোনায় ফাঁকি দিতাম।বাসায় বকা দিতো।গায়ে মাখতাম না। নবনীকে নিয়ে রোজ কবিতা লিখতাম।সেই কবিতা চিঠি আকারে পাঠিয়ে দিতাম ওর ছোটো ভাইকে দিয়ে।


      "এই জীবন প্রেমের কাছে করেছি সমর্পন

      প্রিয়তমা, তোমায় ঘিরে আমার আবর্তন"


কি আবেগ দিয়ে লেখা! নবনী একদিন দেখা করলো আমার সাথে।ধীরে ধীরে প্রেমে রাজী হয়ে গেলো। কি আবেগ! কি ভালোবাসা! দিনগুলো অন্যরকম কাটছিলো। নবনী ওর আসল নাম না।ওর আসল নাম ছিলো, "অরনী"

নবনী নামটা আমি ওকে দিয়েছিলাম।


জীবন চলে নিজের মতো। এক সুন্দর সহজ জীবন হঠাৎ কঠিন হয়ে গেলো।বাইক  এক্সিডেন্টে পা হারালাম। জীবন আমার ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেলো।


খবর টা জানার পর পায়ের মত নবনীও ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলো। পৃথিবীর চরম নিষ্ঠুরতা দেখলাম।মনমরা হয়ে গেলাম।বন্ধু দের সাথে আড্ডাবাজি কমিয়ে দিলাম। ওরা ডাকলেও যেতাম না 


স্ক্যাচার নিয়ে সব জায়গায় বেরোতে খারাপ লাগতো।কান্না পেতো।ধীরে ধীরে ইচ্ছে করে একা হয়ে গেলাম।বন্ধু দের সাথে যোগাযোগ আরো কমিয়ে দিলাম।


ভার্সিটি যাওয়া অফ করে দিলাম।প্রেমিকা হারিয়ে, বন্ধু হারিয়ে নিজেকে নিস্ব মনে হতো।

এদিকে মা বাবা আমার ভেঙে পড়া দেখে কষ্ট পেতো।সাহস দিতো আমাকে।ভার্সিটি যেতে বলতো।


আমি বলতাম, "আমার সাহস আছে। আমি মানুষকে ঘৃণা করি।এজন্য মানুষ কে এড়িয়ে চলি।"


প্রেমিকা, বন্ধু সব হারিয়ে নিঃস্ব আমি ঠিক করলাম পরিবার ছেড়েও চলে যাবো। আত্মীয় স্বজনরা আড়ালে আবডালে খারাপ কথা বলতো।রাত জেগে কান্না করতে করতে চোখের নিচে কালো দাগ হয়ে গেলে।


মানুষের প্রতি অভিমান হতো।প্রেমিকার উপর অভিমান হতো।নবনী নামের কারো কথা মনে হলে, নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না। কান্না কাটি করতাম।


পৃথিবীর সবচে কঠিন কাজ টা করে ফেললাম।পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। অন্য এলাকায়, অন্য শহরে, একাকিত্বের জীবন বেছে নিলাম।


ঘটনা দশ বছর আগের।


এই দশ বছরে আমি বারান্দা দিয়ে পৃথিবীর অদ্ভুত জীব 'মানুষ' কে দেখেছি।  পাখির মত চোখ দিয়ে মানুষগুলোর অহেতুক ব্যস্ততা দেখি। আমার পৃথিবী থেকে ওদের পৃথিবীটা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়।ওদের দেখে হাসি পায়।আফসোস হয়। 


বিকালে গ্রিল ধরে  দাড়িয়ে থেকে সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্সের ছুঁটে যাওয়া দেখি। রোগীর যায়গায় নিজেকে কল্পনা করতেই দেখি, পা কেটে ফেলা হচ্ছে  আমার। যন্ত্রণায় মাথার ভেতর টা ফাঁকা হয়ে যায়।


এই দশ বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসনে আমি অসীম যন্ত্রণায় পুড়েছি। মা বাবার খোঁজ নিয়েছি ফোন করে। ওরা ভালো আছে। আমি আর ওদের সাথে দেখা করতে চাই না কোনোদিন।ওরা ভালো থাকুক। আমিও নিঃসঙ্গতায় খারাপ নেই।


পুড়তে পুড়তে ভেতরটা এত কালো হয়ে গেছে যে, পৃথিবীর কোনো দুঃখ আমার মনে কালো দাগ ফেলতে পারেনা।কিংবা  ফেললেও বুঝতে পারিনা।


দশ বছরে শুধু লিখে গেছি। লেখক হিসেবে চেনে অনেকেই।পাঠকরা আমার জীবন নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করে।আমি ওদের কিছু জানাই না। আমি পর্দার আড়ালের মানুষ। আমার সাথে আমার জীবনের গল্পও আড়ালে থাকুক।


এই আশ্চর্য জীবন টা যাপন করছি, মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয়না। মানুষের সাথে আমিএকমুখী সখ্যতা গড়ে তুলেছি।


মুদি দোকানদার দোকান খুলে।আমি তিনতলা থেকে ওর দোকানে বেঁচা কেনা দেখি।দোকানদারকে কত আপন মনে হয়। অথচ কোনো দিন কথা হয়নি।সে আমাকে চেনে না।আমি চিনি। 


এ শহরে বেশ করেকটা কুকুর আছে।কয়েকটা রোজ রাতে এসে পোলটার কাছে এসে কিছুক্ষণ চিল্লায়।

আমি কুকুর দেখি।কুকুর দের সাথে একমুখী সখ্যতা গড়ে তুললাম। ওরা ঘেউ ঘেউ করে কি বলে, বোঝার চেষ্টা করি।


রোজ সকাল ১১ টার পরপর একটা মেয়ে হাতে ছোটো বাজারের ব্যাগ নিয়ে যায়।মাথায় কাপড়, পায়ে চটি স্যান্ডেল। ছোটো ছোটো পা ফেলে দ্রুতগতির পদক্ষেপ। মাথা নিচু করে হাঁটে। এই মেয়েটার সাথেও একমুখী সখ্যতা হলো।ওর গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলে যাওয়া দেখি।দেখতে দেখতে নেশা হয়ে গেছে সিগারেটের মতো। দ্রুত চললেও,চলনে একটা ছন্দ আছে।আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। মুগ্ধতার নেশা কঠিন নেশা। 


হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, মেয়েটা আসেনি।  আজ হয়তো প্রয়োজন হয়নি বাজারে যাওয়ার। কাল আসতে পারে হয়তো।  পরেরদিনও এলোনা।অপেক্ষা বাড়তে লাগলো।

ওর কি বাজার করতে হয়না আর?

ওর কিছু হয়েছে?

দশ বছরের নির্বাসন জীবনে এই প্রথম কোনো মানুষকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি।লেখায় মন দিতে পারলাম না।


এভাবে একমাস হয়ে গেলো।ওর দেখা নেই।

ও কেমন আছে জানিনা।


আমি এ পৃথিবীর মানুষ।ওই পৃথিবীর একটা মেয়েকে নিয়ে এত চিন্তার কারণ খুঁজে পেলাম না।

জীবনটা খুব অদ্ভুত। 


------------------------------------


দুমাস চলে গেলো।

আমি এখনো ১১ টা বাজলে বারান্দায় এসে বসি।

কড়া করে এক কাপ চা খাই।সিগারেট খাই। ধোঁড়া উড়াই। শূণতা উড়াই।


তারপর স্ক্যাচারে ভর করে চেয়ার টেবিলে বসি। 

এক সকালে সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে

কাগজে খসখস করে লিখলাম,


"ওই পৃথিবীর নাম না জানা মেয়েটি

এই পৃথিবীর একলা কবির নিসঙ্গতার সতীন হয়ে ছিলো

যতদিন,

ততদিন ধরে মায়ার যন্ত্রনা ছিলো। 

যন্ত্রণামুক্ত করে দেয়ার জন্য

কৃতজ্ঞতা। "


তারপর চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে জড় পদার্থের মত অসাড় হয়ে বসে থাকলাম।


এই পৃথিবীতে স্ক্যাচারের উপর ভর করে বেঁচে থাকা ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ মানুষটার মাথায় একটা দৃশ্যের জন্ম হয়। সে দৃশ্যে, অরণী অথবা নবনী অথবা নাম না জানা একটা মেয়ে গুটি গুটি পায়ে দ্রুত হেঁটে যায়।


সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম 

১০ জুন, ২০২০

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়

মানবী - লেখা : সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম