অন্যরকম_ঘরের_আলাপ - সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম



দামী পাঁচতারা হোটেলের একটা ঘর। মোটামুটি অর্ধ উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছি। রুমটা পুরোপুরি অন্ধকার। রুমে আমি একা না। আমার পাশে শুয়ে আছে একজন তরুনী। তরুনী সম্পূর্ণ নগ্ন। যদিও অন্ধকারের জন্য সেই নগ্নতা চোখে দেখতে পাচ্ছি না।
তরুনী অনায়াসে যেকোনো মানুষের চোখে সুন্দরী হিসেবে গণ্য হবে।। সে এসেছিলো দারুন সবুজ রঙের একটা শাড়ি পড়ে। কপালে আবার কালো টিপ। এই তরুনীর সাথে ব্যক্তিগত ভাবে আমার কোনো পরিচয় নেই। নামটাও জানিনা। তবে, হোটেলে এক রাত্রি কাটানোর মত চমৎকার মেয়ে। হোটেল ম্যানেজার আমার জন্য তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
শরীরে হাত দিতে যাবো, এমন সময় বললো,
" লাইট অফ করেন! লজ্জা করেনা লাইট জ্বালায়ে এসব করতে?"
এমন ঝাঝালো ভাবে সাধারণত কোনো মানুষ কথা বলেনা আমার সাথে। সমাজে আমার একটা উচ্চ অবস্থান আছে। যেকোনো লোক, আমার সাথে কথা বলার সময় বেশ বিনয়ের সাথে কথা বলে! টকশো তে আমার মুখ পরিচিত। সমাজ কর্মী হিসেবেও আনার খ্যাতি আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিজনেস আইকন সব মিলিয়ে আনার পরিচয় অনেক। তবু, পতিতার কাছে আমার এসব পরিচয় দিয়ে লাভ নাই।
অগত্যা ইচ্ছের বিরুদ্ধে লাইট অফ করতে হলো। সুন্দরী মেয়েদের সাথে তর্ক করতে ইচ্ছে করেনা আমার।
এসব নিয়ে এত ভেবেও লাভ নেই। যেহেতু তার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো পরিচিতি নেই। গতকালকেও অন্য রুমে ছিলো, অন্য কারো সাথে। কে জানে! সহজ বাংলায়, সমাজ যাকে বলে, বেশ্যা বা পতিতা। আমার অবশ্য এরকম সবুজ শাড়ি আর কালো টিপের সুন্দরী মেয়েকে দেখে বেশ্যা বলতে ইচ্ছে করছে না।
ক্লান্ত দেহ এলিয়ে শুয়ে আছি। একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। সিগারেটের প্যাকেট টা কোথায় রেখেছি মনে নেই। খোঁজার জন্য লাইট জ্বালাতে হবে।
এর আগে মেয়েটাকে জিগ্যেস করে নিতে হবে। যতই হোক, পতিতারও নিজের সম্মান থাকে। তা নাহলে রুমে ঢুকার পর এমনভাবে লাইট অফ করার কথা বলতে পারতো? আমি চাইলেই জোর করে লাইট অন করে রাখতাম। পারতাম, কিন্তু জোর করতে ইচ্ছে করেনি।
এর আগে যত মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছি, কেউ এরকম উঁচু গলায় কথা বলেনি। অবশ্য এটাও ঠিক, এর মত এত সুন্দরীও ছিলোনা আগের গুলো।
মেয়েটা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলসে। সেও ক্লান্ত। একটু অস্বস্তি লাগছে। কি বলবো, বুঝে উঠতে পারছি না।
জিগ্যেস করলাম, 'নাম কি তোমার?'
সে হি হি করে হেসে উঠলো।
"নাম দিয়ে কি করবেন? কাজ হইসে। খুশি হইসেন। ব্যাস"
তরুনীর উচ্চারণ চমৎকার লাগলো। দেখেও ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে মনে হয়। উচ্চবিত্ত পতিতা বলে কথা! হতে পারে, পড়াশোনা করছে কোথাও। হতে পারে, টাকার জন্য এই কাজকে পার্ট টাইম হিসেবে বেছে নিয়েছে।
আমি আর বেশি কিছু জিগ্যেস করার সাহস পেলাম না।
একরম একজন পতিতা জোর গলায় আমার সাথে কথা বলছে, আর তাতে স্বনামধন্য সমাজসেবক, বিজনেস সেক্টরে দেশের পরিচিত মুখ আফজাল সাহেদ থমমত হয়ে যাচ্ছে, ভয়ে প্রশ্ন করতে পারছে না, দেশের মানুষ এটা কল্পনাও পারবে না।
তাছাড়া, আমি একটা পতিতার সাথে শুয়ে আছি, কাল হয়তো আরেকজনের সাথে শুতে যাবো, আরো হাজার হাজর মেয়ের সাথে কত বড় বড় হোটেলে রাত কাটাবো, এটাই বা কে জানে? দেশ আমাকে চিনে, একজন সৎ মানুষ, একজন নিষ্ঠাবান আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে। টেলিভেশনে আমার হাসিমাখা মুখ আর মহৎ বিশ্লেষণ করা বানী শুনে কত শত লোক আমাকে স্যালুট দেয়।
আমি যে খারাপ মানুষ এটা আমি জানি। তবে আমার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ কাজ করেনা৷ জন্মের পর মা বাবা মারা গিয়েছিলো। রাস্তায় রাস্তায় দিন কাটাতাম। কত স্ট্রাগল করে, কত মানুষের হাত পা ধরে ধরে নিজেকে একটা বড় পর্যায়ে এনেছি, অতএব, আমি এখন জীবনটা উপভোগ করতে চাই। এটা আমার প্রাপ্য। এর জন্য একটু আধটু দুর্নীতি করতেই হয়।
পাশে শুয়ে থাকা তরুনী বললো, "আপনার চোখ গুলো সুন্দর অনেক।"
আমি আবারো চমকে গেলাম। এত স্বাভাবিক কথাতেও আমি আজ কেনো এত চমকে যাচ্ছি বুঝে উঠতে পারছি না।
একটা সিগারেট ধরাতেই হবে।
চোখের প্রশংসার জবাবে বললাম, "তুমিও সুন্দর অনেক। আচ্ছা, তুমি কি পড়াশোনা করেছো?"
তরুনী আবার বললো, "এত জেনে আপনার কাজ কি?" আপনি ভাবেন, দেশের মানুষ নিয়া।কালকে টকশোতে যাবেন। বড় বড় বুলি ছাড়বেন। রাতের বেলা বউ বাচ্চা ফেলে হোটেলে আইসা মাস্তি করবেন। আজকে আমার সাথে, কালকে আরেকজনের সাথে। দুর্নীতি কইরা গরীব মানুষের জীবন নষ্ট করবেন। রাজনীতিতে নোংরামি করবেন। এক মানুষ মারার জন্য অন্য মানুষ ভাড়া করবেন।"
আমি এবার রেগে গেলাম, "এই মেয়ে! তুমি কিন্তু প্রথম থেকেই বেশি কথা বলছো! চুপ করো। আমার পরিচয় জানো তুমি?"
মেয়েটা বললো, "পরিচয় জানি বলেই বললাম।"
আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। সিগারেট খোঁজার জন্য এবার লাইট জ্বালালাম৷ জ্বালানোর পরই আমি হতভম্ব। কি আশ্চর্য! বেড খালি। মেয়েটা কই গেলো!
সারা ঘর, ওয়াশরুম, বেলকনি সব দেখলাম। কোথাও নেই। রুমের দরজাও ভেতর থেকে লক।আমি কার সাথে কথা বলছিলাম? এতক্ষণ ধরে কি ঘটলো আমার সাথে? স্বপ্ন দেখছিলাম?
হোটেল ম্যানেজারকে ফোন দিলাম।
"স্যার বলুন!"
"একটু আগে যাকে পাঠিয়েছিলেন, সে কোথায়?"
"স্যার আমরা কাউকে পাঠাই নি এখনও।তবে একজন কে পাঠাবো এখন। কয়েক মিনিটের মাথায় পৌঁছে যাবে"
আমি লাইন কেটে দিয়ে সিগারেট ধরালাম। এত ক্লান্ত লাগছে কেনো! এতক্ষণে খেয়াল হলো, আমি অর্ধ উলঙ্গ। দ্রুত জামা পরলাম।
দরজায় আওয়াজ হচ্ছে। একটু সময় নিয়ে তারপর খুললাম। যাকে দেখলাম, সে হলো, একজন সুন্দরী তরুনী। সবুজ শাড়ি, কালো টিপ। রুমে ঢুকে বললো,
"লাইট অফ করেন"
আমি কিছু বলার আগেই সে লাইট অফ করে দিলো। আজব ব্যাপার। এসব কি হচ্ছে!
অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে দ্রুত বেলকনিতে চলে গেলাম। ধীরে সুস্থে সিগারেট শেষ করলাম।রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। ব্যাপারটা কি ঘটছে বুঝার চেষ্টা করছি। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
তরুনী অন্ধকার ঘর থেকে বললো, "দ্রুত আসেন! কি হলো! আমি শুয়ে পড়সি"
আমি কথা বললাম না।
তরুনী আবার বললো, "স্যার, আসেন। নাকি আমি আপনার কাছে যাব?
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না৷ কিছু একটা করতেই হবে। দ্রুত রুমে যেয়ে আবার লাইট অন করলাম।
কোথাও কাউকে পেলাম না।
সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম

Comments

Popular posts from this blog

তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়

বাংলাদেশের নাটক শিল্পের বর্তমান অবস্থা ও আমার দৃষ্টিভঙ্গি

নির্বাসন (ছোটোগল্প, লেখা : সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম)