মানবী - লেখা : সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম

 এই মুহুর্তে, একজন নারীর উপস্থিতি দরকার।

 

কোনো একটা দৃশ্যপটে নারী উপস্থিত হলে, সে দৃশ্য দ্রুত বদলে যায়। এর পেছনে মূল কারণ বা ব্যাখ্যা অনেক কিছুই থাকতে পারে।  নারীকে যদি দৃশ্য বদলে দেয়ার নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে, এই নিয়ামক কে গূরুত্ব সহকারে ভাবতেই হবে।


কাগজ, কলম নিয়ে বসে পড়লাম। পেন্সিল দিয়ে নারী - তৈরি করবে চিত্রশিল্পীরা। আমি সাধারণ মানুষ। বারবার মেশানোর বালাই নেই। যা আঁকবো, সেটাই চূড়ান্ত। কলম হলেই চলে।খারাপ কিছু তৈরি হলেও আশঙ্কা নেই। ভয় নেই। কেউ মার্ক কাটবে না।


যেহেতু এই মুহুর্তে একজন নারী ভীষণ ভাবে প্রয়োজন, আমার হাত, কলমের সাহায্যে কাগজের উপর একটা নারী তৈরি করে ফেলছে। খুব যে খারাপ হচ্ছে, তা নয়।


"কলমে আঁকা পরী" ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে।

শাড়ি পরিয়ে দিলাম। কপালে দিলাম টিপ। একটা মায়াবতী টাইপ বাঙালীয়ানা নারী তৈরি হলো। 


এমন  অবয়ব  তৈরি হলো,

যাকে দেখে জীবনানন্দ আবেগে আপ্লুত হয়ে বলতেই পারেন , "চুল তার কবেকার অন্ধকার...... "


কিন্তু আজ জীবনানন্দ বিশেষ কারণে অনুপস্থিত। উপস্থিত আছেন -  রবীঠাকুর, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়,  বঙ্কিম, সুনীল এনং হুমায়ূন আহমেদ। 


আমার শ্যামলা রঙের মেয়ে ই পছন্দ। তবে, আমার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে কাজ হবেনা। দৃশ্যপটে উপস্থিত সম্মানিত সকলের কথা শুনতে হবে।

উপস্থিত ছয়জন, বহু মান্যগন্য মানুষ। উনাদের মতামত নেয়া জরুরী। অধীর আগ্রহে তাঁরা অপেক্ষা করছেন।


সুনীল, মানিক, রবীন্দ্রনাথ আর বঙ্কিম সকলেরই শ্যামলা মেয়ে পছন্দ। 

ঝামেলা তৈরি করলেন,  তারাশঙ্কর বাবু।


তারাশঙ্করের মতে, দৃশ্যপট পরিবর্তন এর জন্য কালো মেয়ে আবশ্যক। 


হুমায়ূন আহমেদ কে সিগারেট হাতে নিয়ে ছটফট করতে দেখা গেলো।

কাছে গিয়ে বললাম, স্যার, মেয়ে কি কালো হবে? নাকি দুধের মত ফর্সা?

স্যার বললেন, "মেয়ে হতে পারে - শ্যামলা, কালো বা ফর্সা। তবে, যেটাই হোক, হতে হবে রুপবতী৷ যাকে দেখে সকল  জাগতিক সৌন্দর্য তুচ্ছ মনে হবে।"


পাশ থেকে বঙ্কিম সাহেব খোঁচা মেরে বললেন,, "হুমায়ূন এর কাছে মেয়ের সৌন্দর্যের বর্ণনা মানেই তুলনায় অন্যান্য জাগতিক বিষয় তুচ্ছ।  এক বর্ণনা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেলাম।"


হুমায়ূন ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, " আমি যা লিখি, লোকের কাছে সহজবোধ্য। অন্তত তোমার মত দাঁতভাঙা শব্দ লিখি না"


প্রসঙ্গ অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। সমবয়সী মহান মানুষগুলোকে নিয়ে বিপাকে পড়েছি। আমি সবাইকে আবার মনে করিয়ে দিলাম, "মেয়ে কি শ্যামলা হবে?"

শ্যামলা মেয়ের বিষয়ে এবার কেউ আপত্তি করলো না।

সংখ্যাগরিষ্ঠ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, "নারী হবে শ্যামলা।"


কলমে আঁকা পরী প্রস্তুত। সবাই মুগ্ধ চোখে এক মায়াবতীকে দেখছে... দৃশ্যপট বদলে গেলো।

সুনীল এই মেয়েটির নাম রাখলেন, "নীরা"


আবেগ দিয়ে লিখলেন, 


                   "কাব্যে নয়, নদীর শরীরে নয়, নীরা

                     চশমা-খোলা মুখখানি বৃষ্টিজলে ধুয়ে

                              কাছাকাছি আনো

                      নীরা, তুমি নীরা হয়ে এসো!"


এই নারীকে দেখে গুরু লিখলেন তৎক্ষনাৎ, 

                

                 "পড়েছে তোমার ’পরে প্রদীপ্ত বাসনা,

                  অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।’"


হুমায়ূন সাহেব দুটো শব্দে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন - "বড়ই সৌন্দর্য " বলে।যেহেতু তিনি জীবনানন্দ ভক্ত, আবেগ প্রকাশ করলেন, তাঁর লাইন আবৃত্তি করে।


                "ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার,

              রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,

        চুল যার শাঙনের মেঘ,-আর আঁখি গোধুলির মতো গোলাপী রঙিন;

          আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, স্বপ্নে-কত দিন!"


আবৃত্তি শুনে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো,


"শ্যামলা মেয়ের গাল, রাঙা আপেলের মত কিভাবে হয়?"


প্রশ্ন করার সাহস পেলাম না। হুমায়ূন সাহেব যে জীবনানন্দ কে খুব বেশি মিস করছেন, বোঝা যাচ্ছে। 


গত শতাব্দীর অসম বয়সী  মহৎ মানুষ গুলোর একই বয়সী উচ্ছ্বাস,  খুনসুটি মুগ্ধ চোখে দেখতে  থাকলাম। প্রকৃতি আমাকে এই সুযোগ করে দিয়েছে।


প্রকৃতির রহস্য বোঝা কঠিন। কি এক রহস্যময়ী সৃষ্টি, "মানবী"!  কলমে আঁকা এই প্রাণহীন পরীকে নিয়ে গত 

শতাব্দীর  কতিপয়  মহৎ স্বত্ত্বাদের উচ্ছ্বাস বাঁধভাঙা।

আর উপর থেকে দেখছে, এক সর্বোত্তম সত্ত্বা- জগতের সকল বিষয়ের পাশাপাশি,  প্রাণ ও প্রাণহীনতার ব্যাপার স্যাপারও যিনি একাই সামলান।


মানবী

সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম

১৬ নভেম্বর, ২০২০

Comments

Popular posts from this blog

তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়

বাংলাদেশের নাটক শিল্পের বর্তমান অবস্থা ও আমার দৃষ্টিভঙ্গি

নির্বাসন (ছোটোগল্প, লেখা : সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম)