বাংলাদেশের নাটক শিল্পের বর্তমান অবস্থা ও আমার দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশের নাটকের কথা উঠলে প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে মানুষকে আমি কয়েকশ্রেণীতে ভাগ করি। এক শ্রেণী কিছুটা হতাশ হয়ে নাটকে দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। পুরাতন দিনের বিশেষত ৯০ দশকের কাজগুলোর সাথে বর্তমান সময়ের কাজগুলোর তুলনা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আরেক শ্রেণী আছেন, যারা আশা বাদী। নাটকে বেশ কিছু ভালো কাজ হচ্ছে, যেগুলো তারা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। আরেক শ্রেণী আছে - যারা সবচে গুরুত্বপূর্ণ, তারা বাংলাদেশের নাটক দেখেন না। এ প্রসঙ্গ উঠলেই বলেন, এসব দেখে সময় নষ্ট করিনা। তখন তাদের কে প্রশ্ন করি, সময় কিভাবে কাটান? তারা বলেন যে, ইংরেজি ও হিন্দী সিনেমা, সিরিজে তারা মগ্ন থাকতে ভালোবাসেন।
এখন আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাহলে আমি বলবো, আমি এদের কোনো শ্রেণীতেই পড়িনা। আমি বিশ্লেষণধর্মী মনোভাব নিয়ে নাটক অবস্থা'র কথা তুলে ধরলে, সেখানে একই সাথে আমার হতাশা ও নৈরাশ্যের ব্যাপার উঠে আসবে।
আমাদের তরুন সমাজ বর্তমানে যারা কলেজ বা ভার্সিটিতে পড়ছে, তাদের বেশির ভাগের মাঝে ইদানিং "ব্যাচেলর পয়েন্ট " নামক ধারাবাহিক নাটকটি সাড়া ফেলেছে। এটা কি ভালো দিক না খারাপ দিক?
ব্যাচেলর পয়েন্ট তরুন দর্শক প্রিয়তা পাওয়ার মূল কারণ হিসেবে যেটা দেখছি আমি, সেটা হলো,এখানে নিজেদের জীবনের অবস্থার প্রতিফলন তারা দেখতে পায়। দর্শক যখন নিজের প্রতিফলন স্ক্রিনে দেখতে পায়, তারা সেটা তার মাঝে সাড়া দিবেই।এদিক থেকে ব্যাচেলর পয়েন্ট সফল। তবে, ব্যাচেলর পয়েন্টের সবচে দুর্বল দিক হইলো, কাহিনী বিমুখতা।এখানে কোনে সুনির্দিষ্ট স্রোতে কাহিনী প্রবাহিত হয়না। একারনে, এই নাটকের মাঝে সাহিত্যবিমুখতা প্রকট। নাটকের মাঝে সাহিত্য না থাকলে কি হয়? নাটকের গ্রহণযোগ্যতার স্থায়ীত্বটা থাকেনা।এটা হয়তো সাময়িকভাবে সাড়া ফেলবে, তবে, কালজয়ী হবে না। ৯০ দশকের বাকের ভাই মানুষ এখন যেভাবে স্মরণ করে, এখনকার জনপ্রিয় ব্যাচেলর পয়েন্ট, ১০ বছর পর মানুষ সেভাবে স্মরণ করবে না। কাহিনী ও সাহিত্য বিমুখতা এখানে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
তাহলে বর্তমানে যা কাজ হচ্ছে সেখানে সাহিত্যমুখী নাটক কি একেবারেই নেই? অবশ্যই আছে। তবে, সেটা সংখ্যায় আশঙ্কাজনকভাবে কম।
সাহিত্য বিমুখতা মানেই খারাপ নাটক নয়। বর্তমানে ভালো কাজের সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের ভালো কাজের সংখ্যার চেয়ে বেশি - এটা আমার মত। প্রতি ইদে 'বড় ছেলে' টাইপ কিছু কাজ মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি মোশাররফ করিম অভিনীত 'বোধ' ও 'যে শহরে টাকা ওড়ে' নাটক দুটো যেভাবে সাড়া ফেলেছে, সেটার মূল কারণ, নাটকের উপস্থাপন।সাধারণ কাহিনীকে অসাধারণ ভাবে তুলে ধরে দর্শক হৃদয়ে নাড়া দেয়া এই নাটকদুটোর রেশটা বেশকিছু দিন থেকে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
বর্তমানে জনপ্রিয় অভিনেতা অপূর্ব, নিশো, মোশাররফ করিম,তিশা, মেহজাবীন সহ যারা আছেন (নাম বলে শেষ করা যাবেনা) তারা ট্যালেন্টেড অভিনেতা অভিনেত্রী। তাদেরকে আরো প্রোপারলি ইউস করা গেলে নাটক আরো সমৃদ্ধ হবে।এই দ্বায়িত্বটা পরিচালকদের উপর বর্তায়।
পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্বল বাংলাদেশের নাটক জগতে একটা নতুন মাত্রা আনেন। তার বেশ কিছু নাটক দর্শকদের মনোজগতে বড় রকমের সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো। বিষয়ভিত্তিক মননশীলতা, স্ক্রিপ্ট ও মনস্তাত্ত্বিকবোধ সম্পন্ন নাটকগুলো বাংলাদেশের নাটক জগতে বৈচিত্র আনলেও পরবর্তীতে এই ধারাবাহিকতায় আর কোনো পরিচালককে তেমন সফলভাবে খুঁজে পাওয়া যায় নি।
এই ট্যালেন্টেড পরিচালকের "যে জীবন ফড়িং এর", মহাম শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগের জীবনী অবলম্বনে রচিত নাটক "রোদ মেখো সূর্যমূখী", পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে " দাস কেবিন" সহ বেশ কিছু সৃষ্টি অবশ্যই সময়কে জয় করতে পেরেছে ও ভবিষ্যতেও এটা পারবে বলে আমার বিশ্বাস। মাসুদ হাসান উজ্বল হলেন বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে একজন আন্ডারেটেড নক্ষত্র স্বরুপ। যার কাজ প্রাপ্য মনোযোগ টা কখনোই পায়নি।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালক "মাবরুর রশীদ বান্নাহ" যে কাজ গুলো করেন, যেখানে ইন্টেলেকচুয়ালিটির ছাপ থাকে। কাহিনী খুব বেশি সমৃদ্ধ না হলেও একটা মেসেজ পায় দর্শকেরা।এটা অবশ্যই একটা ভালো দিক। তাছাড়া, আরেকজন পরিচালকের কথা না বললেই নয়। তিনি শাফায়েত মনসুর রানা।ইন্টেলেচুয়ালিটির ছাপ তার নাটকেও বেশ দেখা যায়। যদিও উপরোক্ত দুজনের নাটকেই কাহিনী খুব বেশি সমৃদ্ধ মনে হয় না। তবে, উপস্থাপন ও মেসেজ ডেলিভারি, সে 'সমৃদ্ধ কাহিনী'র অভাবটা পূরণ করে দেয়।
বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর একটি হলো, হুমায়ূন আহমেদের নাটকে বিচরণ। কাহিনী নির্ভরতা,সাহিত্যসমৃদ্ধি,ভাড়ামো বিহীন হিউমারাস নাটক,অথচ নাটকের উপস্থাপনে সরলতা - সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে হুমায়ূন অনন্য।
আমার একটি ব্যাক্তিগত মত আছে। হুমায়ুন আহমদ যদি ঔপন্যাসিক নাও হতেন,তবু নাট্য জগতে অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতেন। বড় মাপের জনপ্রিয় সাহিত্যিক বলেই হয়তো, নাট্যকার হুমায়ূন খুব বেশি আলোচনায় আসার সুযোগ পায়না।পেলেও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের তকমার পাশে সে পরিচয় ম্লান।
দুঃখ জনক হলেও সত্য, হুমায়ূন পূর্ববর্তী ও হুমায়ূন সময়কালে নাটকের সাহিত্যমান থাকলেও হুমায়ূন পরবর্তী সময়ে নাটকে সাহিত্য মান কমে গেছে। শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক,হুমায়ুনের কোথাও কেউ নেই - এগুলোর সাথে বর্তমানের নাটকের মূল পার্থক্য 'কাহিনীনির্মান ও সাহিত্য মান'- এ।
এই যে বললাম, সাহিত্য মান নেই -বর্তমানের অধিকাংশ নাটকগুলোর। কিন্তু কেনো?
উত্তর হলো, এগুলোর স্ক্রিপ্ট কোনো পেশাদার সাহিত্যিক লিখছেন না এখন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ক্রিপ্টটা যেনোতেনো ভাবেই কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়া হয়- যেখানে কাহিনী বিন্যাস ভালো নয়।সংলাপ চয়ন সুখকর নয়। ঠিক একই কথা আমি বলতে পারি, সংগীত জগতের ক্ষেত্রে। লিরিকাল ব্যাপারে সাহিত্যিক পেশাদার গীতিকারদের দারস্থ না হলে বাংলা গানের লিরিকে সাহিত্যমান নিয়ে সংশয় থেকে যাবে।
যেহেতু আলোচনা নাটক নিয়ে, সেহেতু, নাটক প্রসঙ্গেই বলছি। যতদিন পর্যন্ত নাটকের স্ক্রিপ্ট প্রতিষ্ঠিত লেখকদের দ্বারা লিখিয়ে না নেয়া হবে, ততদিন পর্যন্ত নাটকে সাহিত্যমানের অনুপস্থিতি থাকবে, কাহিনী প্রবাহ ও নির্মানে দুর্বলতা থাকবে।
বর্তমানে হিউমারের নাম দিয়ে ভাড়ামোপূর্ণ নাটক দেখা যাচ্ছে, যেটা হতাশা জনক। আশা করি, বিষয়টা এর সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ভেবে দেখবেন। বাংলা নাটকে সবচে সুন্দরভাবে ও চমৎকারভাবে হিউমার প্রয়োগ করেছেন, হুমায়ূন আহমেদ।
বর্তমানের কাজ নিয়ে এজন্য আমি হতাশ পুরোপুরি হতে পারিনা যে, এখনও দর্শক হৃদয়ে নাড়া দেয়ার মতো কাজ হচ্ছে। আবার পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারি না একারনে যে, সাহিত্যমানের অনুপস্থিতি দেখা দিচ্ছে।
তবে, একথা অনস্বীকার্য যে, ওপার বাংলার সিরিয়ালের চেয়ে আমাদের নাটকে মান অনেকাংশে এগিয়ে আছে।সম্ভবত এটা আমাদের জন্য গর্ব করার মত বিষয়। নাটক শিল্পে পরিচালক, অভিনেতা, স্ক্রিপ রাইটার সবাই মনোযোগ দিলে নাটক দিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উপস্থপন করা সম্ভব, যেটা ক্রিকেট ও ব্যান্ড মিউজিক করে দেখিয়েছে।
আমি স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশের নাটক বিদেশী ভাষায় একদিন ভাষান্তর হওয়া শুরু হবে।বিশ্ব জানবে, বাংলাদেশে নাটক শিল্পে কতটা সমৃদ্ধ। তবে, সেজন্য বেশ কিছু প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশের নাটক শিল্পকে।
তাহলে, আমি কোন দলে? হতাশাবাদী না আশাবাদী? আমি নিরপেক্ষ। নাটক শিল্পে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে - এটা আমি বিশ্বাস না করলেও যাবে। আমি শুধু চাই, সাহিত্যমান, কাহিনি নির্ভর নাটক গুলো ফিরে আসুক আবার।তাহলে হয়তো, যে শ্রেণী নাটক দেখাকে সময় নষ্ট বলে নাট সিটকায়, সেই 'গুরুত্বপূর্ণ' শ্রেণীটা নাটকে ফিরে আসবে। পাশাপাশি, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের নাটক ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম
অনেক সুন্দর লিখেছেন ভাই।।।।
ReplyDelete